- 06 August, 2022
- 0 Comment(s)
- 428 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
এই নিবন্ধে যা লিখতে চলেছি, তা হয়তো অস্বস্তি জাগাবে। কিন্তু সেই অস্বস্তি জাগানোটাও আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে করি। যুগ যুগ ধরে যে সামাজিক চোখরাঙানিকে হাতিয়ার করে, যে বিষয়কে নিষিদ্ধ করে রেখে, এমন একেকটি সমস্যার জন্ম দেওয়া হয়েছে, এমন একেকটি সমস্যাকে উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তোলা হয়েছে, আজ সেই সমাজের সকলকেই সেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। এই উদ্দেশ্য থেকেই আজকের নিবন্ধের সূত্রপাত।
ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। অতিমারির প্রকোপ তখন সদ্য সদ্য কাটতে শুরু করেছে। নাটক দেখার শখটুকুও আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। এক শনিবারের সন্ধ্যায় মিনার্ভা থিয়েটারে গিয়ে পড়েছিলাম। নাটক শুরু হতে তখনও খানিক দেরী ছিল। মনে মনে ভাবলাম লম্বা পায়ে খানিক হেঁটে আসি বরং। পথে কোনও ভালো চায়ের দোকানে গলাটাও নাহয় ভিজিয়ে নিয়ে ফিরব। সেই মনে করেই চিৎপুর রোড অবধি গিয়ে পড়লাম, ডানদিকে মোড় নিয়ে এগুলাম। অনেকদিনের বিরতির পর, সেদিন কি কারণে যেন পাঞ্জাবী পরারও শখ হয়েছিল। সুগন্ধিও মেখেছিলাম। হঠাৎ রাস্তার পাশ থেকে, গলির ভিতরে এক বয়স্কা মহিলা ফিসফিস করে ডাক দিলেন, “কেমনটা পছন্দ স্যর? বলুন না। খুব ভালো জিনিস রয়েছে।” ব্যাপারটা বুঝতে যেটুকু সময় লাগে, মাথা নেড়ে এগিয়ে চলে যাচ্ছি – আবারও ডাক এল, “খুব ভালো জিনিস স্যর। পস্তাবেন না একেবারেই। ওই সামনের বাড়ির দোতলাতেই ব্যবস্থা আছে স্যর। ব্রাক্ষ্মণবাড়ির মেয়ে, একেবারে নতুন!” কোনও মতে মাথা নেড়ে জোরকদমে পা চালিয়ে দিলাম। ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, এই পেশাতেও জাতিভেদ আর ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার রয়েছে তাহলে!
নিষিদ্ধপল্লীতে এর আগেও সচেতন ভাবে গিয়েছি। কালীঘাট অঞ্চলের একটি অংশে, সেখানকার বাচ্চা ছেলেমেয়েদের জন্য একটি নৈশ-বিদ্যালয় স্থাপনের চেষ্টা করেছিলাম। সেই সূত্রেই বার দুয়েক সেখানে গিয়েছি। শেষ অবধি লোকবল না মেলায় কাজ এগোতে পারেনি। কিন্তু তখনও খানিক দেখার সুযোগ হয়েছিল। নিষিদ্ধ না বলে দিলে পরে বোঝবার উপায় থাকে না সবসময়। এই পেশাকে আমরা আদিমতম পেশার তকমা দিয়ে বড়াই করে বেড়াই। খদ্দের হিসেবে যাঁরা আসেন, তাঁদের বিষয়ে রা’টি কাড়ি না। আমাদের যত সমস্যা ‘কাজ করে খাওয়া’ এই মেয়েদেরকে নিয়েই। অথচ বেশ্যাবৃত্তি আইনসম্মত হলেও এদের দুঃখ ঘুচবে না। এদের শোষণ এতটুকুও কমবে না, এদের প্রতি অপমানসূচক শব্দ ব্যবহার করতেও আমাদের এতটুকুও বাধবে না। আমরা এদেরকে রূপোলী পর্দার খোরাক, অপমানের ডাস্টবিন আর দুর্গাপুজোর সময় ‘মায়ের মাটি যোগান দেওয়ার কাণ্ডারী’ বলে সাময়িক মৃদুমন্দ সম্মানের পাত্রী বলে মনে করে এসেছি। তেমনটাই আমাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে থেকে গিয়েছে।
কিছুদিন আগে একটি তথ্যচিত্র দেখেছি। বাংলাদেশের দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর উপরে আধারিত ২৪ মিনিটের সে এক মর্মস্পর্শী উপাখ্যান। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যৌনপল্লীগুলির মধ্যে এই দৌলতদিয়ার নাম গোড়ার দিকেই এসে পড়ে। প্রায় ২০০০ মহিলা এই মুহূর্তে সেখানে যৌনপেশায় কর্মরত রয়েছেন। তথ্য বলছে প্রতিদিন (অথবা প্রতিরাতে) এই দৌলতদিয়াতেই কেবল ৩৫০০ মানুষ ‘পরিষেবা’ নিয়ে থাকে। এই দৌলতদিয়ার অস্তিত্ব কিন্তু আইনত নিষিদ্ধ নয় মোটেও। ইসলামিক দেশগুলির মধ্যে এক বিরল উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ আঠেরো বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌনপেশাকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু, তথ্য এও বলছে দৌলতদিয়াতে প্রতিবছর গড়ে যে ১০০জন করে ‘নতুন মেয়ে’ আমদানি হয়ে থাকে, নতুন এই পেশাতে নিযুক্ত হয়ে থাকে – তাদের গড় বয়স হলো মাত্র ১৪ বছর। নতুন এই মেয়েদের পরিষেবা পেতে গেলে খদ্দেরকেও প্রায় ২০গুণ বেশি মূল্য গুণতে হয়। তবে এই ২০গুণের হিসেবে না যাওয়াই ভালো, কারণ তথ্য এও বলছে যে – এই দৌলতদিয়াতে ক্ষেত্রবিশেষে মাত্র ৪০০ ভারতীয় মুদ্রা খরচ করলেই পরিষেবাপ্রদানকারী মেয়েটি কোনওরকম নিরাপত্তা ছাড়াই সঙ্গমে লিপ্ত হতে রাজি থাকে। বয়স, নিয়ম, আইন – সবই এখানে ক্রয়ের বস্তু মাত্র। প্রজন্মের পরে প্রজন্ম এখানে যৌনপেশায় জড়িত থেকে চলেছে, এমনই উদাহরণ প্রচুর। স্বাস্থ্য অথবা রোগনিরাময়ের বিষয়ে প্রায় কোনও খেয়ালই থাকে না। ন্যূনতম ১০বছর বয়স থেকে শুরু করে, ৩৫-৪০ বছর বয়স অবধি এদের কার্যকালের মেয়াদ। দামও ঠিক হয় সেই বুঝেই। ১৮র চেয়ে বয়স যত কম হবে, সরকারি লাইসেন্স পেতে গেলে ঘুষের পরিমাণও সমানুপাতে বাড়তে থাকবে। এমনটাই দস্তুর এখানে। নিজেদেরকে স্বাস্থ্যবতী করে তুলতে, খদ্দেরের চোখে আকর্ষণীয় করে তুলতে গবাদি পশুদের পেশী বাড়ানোর জন্য যে ওষুধ খাওয়ানো হয়, তাই এখানকার মেয়েদেরও খাদ্যতালিকাতে জায়গা করে নিয়েছে। এরফলে তাদের আয়ু কমেছে ঠিকই, বদলে বেড়েছে খদ্দেরের নিশ্চয়তা। শরীরের মধ্যেও সবচেয়ে আগে যে পেট, তার জঠরানলকে নেভাতে নেভাতেই তো মানুষের দিনগুজরান হয়।
বাংলাদেশে এমন ২০টিরও বেশি যৌনপল্লীর অস্তিত্ব রয়েছে। এদের মধ্যে অবস্থানগত কারণেই দৌলতদিয়ার সমৃদ্ধি ঘটেছে। ঢাকা শহরের পশ্চিমে ১০০কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দৌলতদিয়া অঞ্চল। নদীর পাড়েই এই জনপদের গড়ে ওঠা। কাজেই সারা দেশ থেকে যে সমস্ত পরিবহণ এসে দৌলতদিয়ার ফেরিঘাট ধরেই নদী পেরিয়ে রাজধানীর দিকে যায়, প্রধানত তাদের চালক-খালাসিদেরই লালসা পরিতৃপ্তিতে দৌলতদিয়ার বেড়ে ওঠা। এরও সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবেশ পরিবর্তন ও রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের উপস্থিতি। প্রায় ৭লক্ষ রোহিঙ্গা নরনারী এই মুহূর্তে বাংলাদেশের আশ্রয়প্রার্থী। তাদের ভিতরে ৫০শতাংশই হলো নারী অথবা শিশু। এদের ভুখা পেটকে বোজাবে কে? অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূল অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৮শতাংশ মানুষ এখন চরম সংকটের মুখে দিন কাটাচ্ছেন। তথ্য বলছে পরিবেশ পরিবর্তনের এই হার বজায় থাকলে, ২০৫০সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭শতাংশ পরিমাণ স্থলভূমিই নদী বা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। অন্তত দু’কোটি মানুষ গৃহহীন হবেন। এই আবহাওয়া-শরণার্থীদেরও জনস্রোত ইতিমধ্যেই ঢাকা শহরে আছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এদের কারণেই ঢাকা শহরের ৪০শতাংশ মানুষ এখন বস্তিবাসী হয়ে পড়েছেন। আবহাওয়া-শরণার্থীদেরও একটা বড় অংশেরই ভুখা পেটের আশ্রয় জুটছে দৌলতদিয়ারই মতো কোথাও। কারুরই কিছু বলার থাকছে না। অদ্ভুৎ এক সময়ের সুমুখে দাঁড়িয়ে আমরা অন্ধকারের দিকেই ক্রমাগত এগিয়ে চলেছি। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে আরও একটি মজার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। দৌলতদিয়া থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় নদীপথে জলস্তর বৃদ্ধির কারণে আগে একই সময়ে যত সংখ্যক ট্রলার বা স্টিমারে নদী পার হওয়া যেত, তেমনটা আর সম্ভব হচ্ছে না। কাজেই দূরদূরান্ত থেকে আসা ট্রাক ড্রাইভার, বাস ড্রাইভারদেরকে আরও বেশি সময় ধরে নদীর পাড়েই অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সেই সময়ের অবকাশেও তাই দৌলতদিয়ার মেয়েরাই মনোরঞ্জনের সমাধান হয়ে উঠছে।
তথ্য বলছে আধুনিক দাসপ্রথা বা মানুষপাচারের চক্রগুলিকে নিয়ে গবেষণা করলে পরে দেখা যাবে, সেই মানুষপাচারের মধ্যে মাত্র ৫শতাংশ পাচারেরই কারণ হচ্ছে যৌনব্যবসা অথবা যৌনকর্মী পাচার। অথচ, মানুষপাচারের এই অর্থনীতিতে মোট মুনাফার ৫০শতাংশেরই উৎস হচ্ছে যৌনব্যবসার এই বেচাকেনার খতিয়ান।
আমরা জানিনা এর সমাধান কোথায়। আদিমতম পেশার তকমাতে সাজিয়ে, দীর্ঘ সময় ধরে এক নিষিদ্ধ, অপমানজনক, নোংরা পেশার অপমান লেপে দিয়ে – আমরা একে প্রজন্মের পরে প্রজন্ম পেরিয়ে ধারাবাহিক এক নরকে পরিণত করেছি। আইনি সহায়তা, স্বেচ্ছাসেবকদের প্রাণপাত পরিশ্রম কিছুতেই এদের অবস্থার সামগ্রিক পরিবর্তন সম্ভব কি না বুঝে উঠতে পারিনা। আমরা আইনের মাধ্যমে এদের স্বীকৃতি দিলেও, সামাজিক ও মানসিক স্বীকৃতি যতদিন না দিতে পারব – ততদিন এরা উচ্ছিষ্ট হিসেবে বেঁচে থাকবে। এদের স্বাস্থ্য, সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা, কোনও কিছুই নিশ্চিত করা যাবে না। এই পেশার যারা গ্রাহক, তাদেরকে হঠাৎ করে সুবুদ্ধি প্রদান করে ফেললেও – বিরাট এই যে জনসংখ্যার মানুষ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন, তাঁদেরকে এক দিনে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা যাবে না। এই সমস্যাকে প্রথমে কেবল অনুধাবন করা প্রয়োজন। খোলা মনে, খোলা আঙ্গিকে আলোচনা করা প্রয়োজন। এ ব্যতীত এমন সমস্যার সমাধান অসম্ভব।
দৌলতদিয়াতে প্রায় প্রতিদিনই পিতৃপরিচয়হীন একাধিক শিশুর জন্ম হয়ে থাকে। অস্বাস্থ্যের কারণে মাতৃত্বজনিত মৃত্যু অথবা শিশুমৃত্যুর হারও সেখানে বেশি। সরকারি তরফে এখন দৌলতদিয়ার বাইরের অংশে এই যৌনকর্মী ও তাদের পরিবারের জন্য একটি সংরক্ষিত কবরস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর আগে অবধি নদীর চরে লাশ পুঁতে দেওয়া অথবা জ্বালিয়ে দেওয়া ভিন্ন তাদের আর কোনও উপায় ছিল না। কলকাতার যৌনপল্লীগুলিতে, এবং দৌলতদিয়াতেও অনেক মানবাধিকার সংগঠন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে চলেছে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে সমাজের বাইরের স্তরটিতে সরাসরি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। সমাজের সাত্ত্বিকতার মুখোশ খুলে দেওয়ার সময় এসেছে। সমস্ত পেশার, সমস্ত মেয়েদের প্রয়োজনে তাদের সার্বিক নিরাপত্তা ও স্বীকৃতির এক অন্যতম প্রধান পদক্ষেপ হিসেবে এই বিষয়টিকেও বিবেচনা করা উচিত বলে মনে হয়েছিল। সেই থেকেই এই ‘অস্বস্তিকর’ প্রবন্ধের সূত্রপাত। অপ্রিয় সত্যতেও মানুষের চোখ খুলে দেওয়ারই বড় প্রয়োজন এখন।
0 Comments
Post Comment